ভিআইপি প্রোটোকলে মানি লন্ডারিং।গোপন প্রতিবেদন

0

একটি সরকারি সংস্থার একটি গোপনীয় প্রতিবেদন অনুসারে, বিদেশ ভ্রমণের সময় শিথিল স্ক্রিনিং পদ্ধতির কারণে অনেক ভ্রমণকারী অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ডলার পাচার করছেন। যারা ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে বিদেশে যান তারা বিমানবন্দরে সুবিধা পান। তল্লাশি অভিযানে সীমান্ত অতিক্রম করতে তাদের ঝুঁকি নিতে হয় না। এই সুবিধা ব্যবহার করে ভিআইপি প্রটোকল বিদেশি যাত্রীরা ডলার পাচার করছেন। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভ্রমণ, চাকরি, চিকিৎসা, ব্যবসাসহ নানা কারণে বাংলাদেশিদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা ডলার সংকটের আরেকটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে (গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) শুধুমাত্র ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশে যাওয়ার পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষ দিকে দুই শতাধিক বাংলাদেশি ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে দুটি পৃথক কর্মসূচিতে বিদেশে গেছেন। এদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। বিমানবন্দরে ভিআইপি সুবিধা ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে ডলার পাচার করেছে বলে তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই চার মাসে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৬৮৩ বাংলাদেশি শুধু ভ্রমণের জন্য বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বেড়াতে গেছেন মাত্র ৫ লাখ ২৫ হাজার ৩৪০ জন। প্রত্যেক বিদেশি ভ্রমণকারী ন্যূনতম ৫০০ ডলার নিয়ে গেলেও চার মাসে দেশ থেকে ৩৬ কোটি ৬৮ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ ডলার বিদেশে নিয়ে গেছে। তারা বিভিন্ন ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জ এবং কার্ব মার্কেট থেকে এসব ডলার সংগ্রহ করে। এ ছাড়া চার মাসে ভারতে গেছেন ৯৬ হাজার ২২৫ জন। পর্যটক হিসেবে তারা ন্যূনতম ৩০০ ডলার সঙ্গে নিলে ওই সময় ২ কোটি ৮৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ ডলার নিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে কেউ যাতে আন্ডার ইনভয়েস বা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে ডলার পাচার করতে না পারে সেদিকে আমরা সরাসরি খেয়াল রাখছি। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে ডলার পাচার রোধেও কাজ করা হচ্ছে। তবে বিমানবন্দরে তল্লাশি শিথিলতার ভিত্তিতে ডলার পাচার হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো: কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ভিআইপি যাত্রীদের বিমানবন্দরে কম সময় লাইনে দাঁড়ান। তবে তারা নিরাপত্তা পরীক্ষার বাইরে থাকেন না। শুল্ক আইন অনুযায়ী তারা কত ডলার বহন করছে তাও খতিয়ে দেখা হয়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশিদ বলেন, কেউ পাচারের উদ্দেশ্যে ডলার মজুদ করছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ডিবির একাধিক টিম তৎপর রয়েছে। ডলার নিয়ে কারো কারসাজির তথ্য সামনে এলেও আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাব।’

গোপনীয় প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমে যাওয়ায় অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্যত্র বিনিয়োগ করছেন। অনেক ধনী ব্যক্তি বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে টাকাকে ডলারে রূপান্তর করছে।

ডলারের কারসাজির আরেকটি নতুন দিকও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রতিদিন শত শত ভিসাও দেওয়া হয়। এক শ্রেণীর দালাল যাত্রীদের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে ডলার নিচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ ভ্রমণ প্রায় বন্ধ ছিল। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর গত বছরের শেষ থেকে বাংলাদেশিরা ভ্রমণ, চিকিৎসা, স্বজনদের সঙ্গে দেখা, কাজ ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তারা বিদেশে খরচের জন্য ডলার অনুমোদন করছে।

গোপন প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, দেশের মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখা, গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করা এবং অর্থপাচার রোধ করা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। ভিআইপি যাত্রী এবং তাদের সহযোগীরা যাতে বিদেশ ভ্রমণের সময় কোনও নিরাপত্তা চেক থেকে অব্যাহতি না পান তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সেখানে কঠোর শর্ত এবং ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার অনুমোদনের ওপর নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার পাচার এড়াতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে বলা হয়, ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ কর্তৃক নির্ধারিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের নিয়ন্ত্রক ও পদ্ধতি ভিন্ন। সাধারণত মানি এক্সচেঞ্জ এবং কার্ব মার্কেটে ব্যাংক ডলারের বিনিময় হারের চেয়ে কয়েক টাকা বেশি দামে ক্রয়-বিক্রয় করে। সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

গোপন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করোনা ভাইরাসের পর দেশের বাইরে থেকে নতুন যন্ত্রপাতি, সুতা, তুলাসহ সব ধরনের কাঁচামালের চাহিদা ও দাম বেড়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়লেও সে তুলনায় ডলার আসেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *