গভীর রাতে আগুনে আঙ্গার একই পরিবারের পাঁচজন

0

বাড়ির পাশেই ছোট্ট মন্দির। রাতে সেখানে কীর্তনের আয়োজন করেন খোকন বসাক। কীর্তন চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। তিনি কীর্তনও করেন, পরিবারের সদস্যরাও শোনেন। রাতের খাবারের পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। মাঝরাতে হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখা। আগুনের আওয়াজ ও আটকে পড়া মানুষের আর্তনাদ শুনে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও ছুটে আসেন। কিন্তু আগুন নেভানোর পর ধ্বংসস্তূপে পাঁচজনের লাশ পাওয়া যায়। দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের পাঁচ সদস্য। তাদের দুটি সন্তানও রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মাটির চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে যা পুরোপুরি নিভেনি।

ভাগ্যক্রমে খোকন বেঁচে গেলেও তার শরীরের কিছু অংশ পুড়ে যায়। বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের মহাজনপাড়ায় এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

আগুনে খোকন বসাকের বাবা কাঙাল বসাক (৭০), মা ললিতা বসাক (৬০), স্ত্রী লাকি বসাক (৩২), ছেলে সৌরভ বসাক (১২) ও মেয়ে সায়ন্তী বসাক (৭) মারা যান। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪২ বছর বয়সী খোকন।

পেশায় অটোরিকশা চালক খোকনও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যাওয়ায় তিনি হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। তার পুরো পরিবার হারানোর ভয়ঙ্কর বেদনায় তিনি ভুগছেন।

প্রতিবেশী স্বপন শীল জানান, গভীর রাতে বাড়িতে আগুন লাগে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বাড়িতে আগুন লাগার পর তা খোকন বসাকের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে। তারপর রান্নাঘরের দরজা ভেঙে বেরিয়ে এলেন। এ সময় খোকনের বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান। কিন্তু খোকন জ্বলছে। বেঁচে থাকার জন্য প্রিয়জনের অনুনয় কানে পৌঁছালেও তিনি কিছুই করতে পারেননি। আগুনের লেলিহান শিখার কারণে প্রতিবেশীরাও খোকনের পরিবারের সদস্যদের ভেতরে ঢুকে বের করতে সাহস পায়নি।

একপর্যায়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলে ঘরের মধ্যে পাঁচটি পোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি প্রতিবেশীরা। অনেকে হাউমাউ করে কাঁদলেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মরদেহ উদ্ধার করে।

জানা গেছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক খোকন তার বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আধাপাকা (পাকা দেয়াল ও টিনের চালা) বাড়িতে থাকতেন। তিন কামরার বাড়িতে একটি মাত্র দরজা ছিল। ওই দরজার কাছেই ছিল তাদের রান্নাঘর। রান্নাঘরের চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে সেখানে মজুত বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কাঠের মাধ্যমে পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের উৎস ছিল ঘরের একমাত্র দরজার আশেপাশে। তাই শিশুটি বের হতে পারলেও বাড়ির অন্য সদস্যরা ঘুমন্ত অবস্থায় বাইরে আসতে পারেনি। আগুন তাদের গ্রাস করে।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় এক দশক আগে এই বাড়িতে আবারও আগুন লেগেছিল। সেবার কোন ক্ষতি হয়নি।

কয়েকদিন পর বসাকের স্ত্রী লাকির রাঙামাটি যাওয়ার কথা ছিল। তার সঙ্গে তার বড় বোন মনি দে এবং ছোট বোন ঝর্ণার কথা ছিল। কিন্তু বোনের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে ছুটে আসেন ওই দুই বোন। তাদের একজন জানান, তিন বোন ও সন্তানকে নিয়ে রাঙামাটিতে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন আমরা কার সাথে বেড়াতে যাব? বোনের দুই সন্তান থাকল না। সংসারে বোনের আর কোনো স্মৃতি থাকল না।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল হামিদ জানান, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। প্রায় ৪০ মিনিট চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। খোকন বসাককেও উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আগুন নেভানোর পর তার পরিবারের পাঁচজনের মরদেহ পাওয়া যায়। মরদেহগুলো পুড়ে গেছে অঙ্গারে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চুলা পুরোপুরি না নিভানোর কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করছেন তারা। তদন্ত সাপেক্ষে বিস্তারিত জানানো হবে।

পারুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাহেদুল রহমান তালুকদার জানান, রাতে বাড়িতে শুকনো পাতা দিয়ে রান্না করা হতো। পরে খোকন বসাকের পরিবারের সদস্যরা আগুন পুরোপুরি না নিভিয়ে ঘুমিয়ে যান। ফলে চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আর রুমে একটাই দরজা ছিল। ওই দরজার সামনে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশাও আগুন ধরে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, অটোরিকশার গ্যাস সিলিন্ডারে বিপর্যস্ত হয়ে আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে কেউ ঘর থেকে বের হতে পারে নেই। গভীর রাত হওয়ায় প্রতিবেশী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা আসার আগেই সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অটোরিকশাটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

খোকন বসাকের ছেলে সৌরভ ও মেয়ে সায়ন্তীর স্বপ্ন ছিল ভালো তবলা বাদক ও নৃত্যশিল্পী হওয়ার। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *