প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের উল্টোপথে সচিবরা

0

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে তার অফিসের প্রথম দিনে, চতুর্থবারের মতো সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরে, তিনটি বিষয়ে কাজ করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। তার মধ্যে একটি ছিল ‘দুর্নীতিবিরোধী’। গত বছরের সচিবদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আরও জোরালোভাবে এই বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, এত বেতন-সুবিধা সত্ত্বেও দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। বাস্তবে প্রশাসনে দুর্নীতি প্রতিরোধে শক্ত অবস্থান দেখা যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির ক্ষেত্রে নমনীয় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবারো সচিব সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

স্টেকহোল্ডাররা মনে করেন, সম্পদের নিয়মিত হিসাব-নিকাশ সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারত। কিন্তু ১৯৭৯ সালে করা এই নিয়মটি কয়েক দশক ধরে কাগজপত্রে নথিভুক্ত রয়েছে। প্রায় কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব সম্পদের হিসাব-নিকাশের পদক্ষেপ নেননি। সচিবদের কেউই নিজেদের সম্পদের হিসাব করে উদাহরণ তৈরি করেননি। উল্টো এই নিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সচিবরা।

সম্প্রতি আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে বিধিমালা-১৩-এ বলা হয়েছে, চাকরিতে যোগদানের সময় সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দিতে হবে। এরপর প্রতি ৫ বছর পর পর সম্পদ হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব সরকারের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে, সচিবরা সম্পদের হিসাব নিশ্চিত করার জন্য দায়ী। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিবের পক্ষ থেকে এমন কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। উল্টো এই বিধানকে দুর্বল করার নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই। এমন প্রশ্ন করা হলে গতকাল সন্ধ্যায় সাবেক সচিব বদিউর রহমান বলেন, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিলে দুর্নীতি ঠেকানো যাবে না। একজন ইউএনও (ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর) এর ওপর হামলার পর সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির জোরালো অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? তিনি আরও বলেন, আগে বুঝতে হবে আমাদের সরকার দুর্নীতিমুক্ত সচিব চায় কি না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪৩ বছর আগে ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা’ জারি হওয়ার পর কর্মচারীদের প্রতি বছর বেতন দেওয়ার নিয়ম ছিল। প্রায় কেউই সেই নিয়ম অনুসরণ করেনি (ব্যতিক্রম)। এরপর শীর্ষ কর্মকর্তারা ২০০২ সালের দিকে নিয়ম সংশোধন করে এক বছরের পরিবর্তে প্রতি ৫ বছরে সম্পদের হিসাব দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু প্রায় কেউই এই নিয়ম মানছেন না। এখানেই থেমে নেই। নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে প্রতি ৫ বছর পর সম্পদের হিসাব রাখার বিধানও অপসারণের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ মে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে বিধি সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এতে নিয়মানুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হিসাব বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু সচিব কমিটি এই বিধান সরিয়ে দিয়ে এনবিআরকে দেওয়া সম্পদের হিসাব পর্যাপ্ত কিনা তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছে। সে অনুযায়ী আচরণবিধির খসড়া এখন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে আবারও সচিব কমিটির কাছে মতামত পাওয়ার পর বিধিমালা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।

কোনো জরুরি পদক্ষেপ নেই: নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছরে সম্পদের হিসাব করা একটি স্বাভাবিক অভ্যাস। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব না দিয়ে সুস্পষ্টভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করছেন। কিন্তু কোনো পর্যায়েই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কেন এমন হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একাধিক স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে । তাদের বেশির ভাগই বলেন, যে মন্ত্রণালয়ের সচিবরা সম্পদের হিসাব বিধিমালা অনুযায়ী জমা দেন না, সেই মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন জমা দেবেন?

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী মনে করেন, দুর্নীতি রোধে যে মনিটরিং দরকার তা মন্ত্রণালয়গুলো করে না। যা আছে তাও দুর্বল। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তারা দুর্নীতি না করে। এরপরও দুর্নীতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

পিছু হটেছে ভূমি মন্ত্রণালয় : চলতি মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার বড় উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সফল হতে পারেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *