বেকারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও চওড়া

0

বাবা অনেক টাকা খরচ করে আসনাদ আহমেদ সজলকে পড়ান রাজধানীর বনেদী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি নর্থ সাউথে। অধ্যয়নের বিষয় আরও আকর্ষণীয় – কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই)। বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জনের পর অবশেষে তিনি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে ‘কম্পিউটার অপারেটর’ হিসেবে চাকরি পান। উল্লিখিত পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চাওয়া শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাস। চমকপ্রদ তথ্য হলো- এই পদে নিয়োগ পেয়ে গত অক্টোবরে যারা কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ২০ শতাংশই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ‘কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’। সিএসই পড়ে সজলের পথে হেঁটেছেন মো. ফয়সাল হোসেন, মোঃ গোলাম রাব্বি, মৃণাল দেবনাথ, লাকী সুলতানা লাভলী ও আল আমিন হোসেন বিপ্লব। শুধু তাই নয়, এই নিয়োগে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে যারা সরকারি চাকরি পেয়েছেন তাদের ৮০ শতাংশই দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।

সজল, ফয়সাল, লাভলীর মতো অনেকেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরির বাজারে ধাক্কা খাচ্ছেন। এমনই একজন নীলফামারীর রাজা। ২০ সেপ্টেম্বর, তিনি ফেসবুক লাইভে এসে তার শিক্ষার সমস্ত সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন এবং বেকারত্বের ক্ষোভ মেটান। তিনি বলেন, চাকরির বয়স শেষ, সার্টিফিকেট রেখে লাভ কী? শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছেন না আরেক বেকার কবিরুল ইসলাম। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্ষেপের সঙ্গে লিখেছেন- ”আমাকে তোমার সিভি দাও, দেখি কী করতে পারি।’ “এটি সবচেয়ে বড় মিথ্যা আশ্বাস এবং বেকারত্বের সবচেয়ে বড় উপহাস।”

দেশে বেকারের সংখ্যা কত? এই বিষয়ে সবসময় আলোছায়া. সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যের মধ্যেও রয়েছে বড় ব্যবধান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, দেশে সক্রিয় বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। দেশের চাকরির বাজার দীর্ঘদিন ধরে সংকটে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের বড় ধাক্কা ও ডলার সংকটসহ নানামুখী চাপে দেশটির অর্থনীতি। পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা। কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রকল্পে অর্থের প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় স্তরেই বিনিয়োগ কমছে। বিনিয়োগই কর্মসংস্থানের উৎস, এইভাবে প্রাথমিক উত্সগুলি আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় না। বিগত দুই দশক ধরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ইতিবাচক প্রবণতায় থাকলেও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের পরিস্থিতি স্বস্তি পায়নি। করোনা পরিস্থিতির চাপকে সামনে রেখে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় বেকারদের কপালের ভাঁজ এখন চওড়া।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেকারত্বের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারীর প্রতি সহিংসতা, কিশোর গ্যাং, মাদক, ডাকাতিসহ নানা সমস্যা। বাংলাদেশে বেকারত্বের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফলে এ সমস্যা সমাধানে সরকার কী উদ্যোগ নিচ্ছে তার কোনো স্পষ্ট চিত্র নেই নীতিনির্ধারণী মহলেও। তাই, বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সব মনোযোগ দেওয়া হয়। তবে অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে সেই ভাবনায় জল আসছে না।

বেকারত্ব নিয়ে অনেক কথা: বেকারত্বের সংজ্ঞা ও হার নিয়ে অনেক কথা আছে। এ অবস্থায় বেকারত্বের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংগঠনের অনারারি ফেলো। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশে বেকারত্বের যে উপায় ও সংজ্ঞা, সেই সংজ্ঞা স্থির ও অবাস্তব।’

বাংলাদেশ শ্রম বাহিনী সমীক্ষা বেকারত্বকে সংজ্ঞায়িত করে- ‘১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী একজন ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি সক্রিয়ভাবে কাজ চাওয়া সত্ত্বেও বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কাজ করেননি।’ কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এই সংজ্ঞার সাথে একমত নন। তাদের দাবি, এই সংজ্ঞা বাংলাদেশের বেকারত্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আংশিক কর্মসংস্থানের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং, এই সংজ্ঞাটি মোট দেশীয় পণ্যের অন্যান্য উপাদানগুলির মধ্যে মৌলিক ভারসাম্যহীনতাকে প্রতিফলিত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *