আজগুবি খরচ দেখিয়ে বাস ভাড়া বৃদ্ধি

0

ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারী লক্কড়ঝক্ক বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের বার্ষিক ব্যয় ১০০ কোটি টাকা! প্রতি তিন মাস অন্তর ২৬ হাজার টাকায় টায়ার লাগানো হয়! টায়ার-টিউবের বার্ষিক খরচ ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা! ইঞ্জিন ওভারহোলিং করতে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা লাগে! সংস্কারে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা! চালক ও শ্রমিকদের মজুরি বছরে সাড়ে ৭ লাখ টাকা (মাসে প্রায় ৬০ হাজার)! ডিজেলের দাম বাড়ার পর বাসের ভাড়া বাড়ানোর অযৌক্তিক খরচ প্রকাশ করেছে খোদ জাতীয় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভাড়া সংশোধন কমিটি। তাদের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকায় একটি বাস কিনতে বার্ষিক বিনিয়োগ, মোবাইল, যন্ত্রাংশ, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, বেতনসহ ২৩ লাখ ১৪ হাজার ৮৪৮ টাকা! ডিজেল বাবদ ব্যয় হয় আরও ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৬০০ টাকা। দূরপাল্লার বাসের বার্ষিক খরচ ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার ২৩ টাকা! ডিজেলের দাম ৩৭ লাখ ৩৫ হাজার ৬৯২ টাকা।

এক লিটার ডিজেল ঢাকায় আড়াই কিলোমিটার এবং মহাসড়কে ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার চলে। এ হিসাবে ঢাকায় প্রতি কিলোমিটারে ডিজেলের দাম ৪৫ টাকা ৬০ পয়সা। এছাড়াও দেখানো খরচ অতিরঞ্জিত হয়. ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর আগে, প্রতি কিলোমিটার জ্বালানীর দাম ছিল ৩২ টাকা।

একাধিক পরিবহন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে  স্বীকার করেছেন, চাঁদা ও পুলিশের ঘুষের কারণে প্রতি বাসে বছরে ৫-৬ লাখ টাকা যায়। এটি ব্যয় বিশ্লেষণে দেখানো যাবে না। ফলে বাকি খরচ বাড়াতে হবে।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি বাসের রয়েছে ১৬টি এবং দূরপাল্লার বাসে ১২টি কস্ট সেক্টর রয়েছে। সিটি বাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। দূরপাল্লার বাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। ১০ বছরের বাসের আয়ুষ্কালের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ, রেজিস্ট্রেশন ফি ও অন্যান্য কর যোগ করে বিনিয়োগ বাবদ সিটি বাসের বার্ষিক খরচ হচ্ছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ২০৬ টাকা। দূরত্বের ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে ৮ লাখ ৯৪ হাজার ২০৬ টাকা।

তবে নিয়ম অনুযায়ী বাসের আয়ুষ্কাল ২০ বছর। গত ২৭ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের বৈঠকে বাসের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর বাড়ানোর আবেদন করতে ব্যর্থ হন মালিকরা। তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক চৌধুরী ১০ বছরের আয়ুকে প্রতারণা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ঢাকার ৯৮ শতাংশ বাস চলাচলের অনুপযোগী। দূরপাল্লার বাসের ৪৮ শতাংশের বয়স ২০ বছরের বেশি। অযৌক্তিক খরচ দেখিয়ে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।

অতিরঞ্জিত ব্যয় দেখিয়ে ভাড়া বৃদ্ধির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি বলেন, মালিকদের দাবি অনুযায়ী কিছুই হয়নি। প্রতিটি খরচ বিভিন্ন সরকারী সংস্থা, ভোক্তা প্রতিনিধিদের পরামর্শে নির্ধারিত হয়।

বিআরটিএ পরিচালক সিতাংশু শেখর বিশ্বাস, ব্যয় সংশোধন কমিটির প্রধান বিদেশ থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি। তার বিকল্প হিসেবে গত শনিবার ভাড়া পুনর্নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা আরেক পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লাকে পাওয়া যায়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, শুধু ডিজেল নয়, সব খরচ বেড়েছে। বর্ধিত ভাড়া দিয়েও মালিকের পক্ষে লাভ করা কঠিন।

ভাড়া নির্ধারণে দেখানো হয়েছে, শহরের পরিবহন বাসগুলিতে প্রতি ২৫ দিনে একবার ইঞ্জিন তেল (মোবিল) পরিবর্তন করা হয়। এর দাম ৫ হাজার ৮৮০ টাকা। মবিল, দুই ধরনের ফিল্টার পরিবর্তন ও গ্রিজিং বাবদ প্রতি মাসে খরচ হয় ১১ হাজার ৬৮০ টাকা। তিন মাসে একবার ক্লাচ প্লেট, চার জোড়া ব্রেক জুতার দাম ২৭ হাজার টাকা।

কার্গো মালিক শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের নেতা মো. স্বপন জানান, প্রতি তিন-চার মাস অন্তর কাভার্ড ভ্যান পরিবর্তন করা হয়। বাসেও একই কাজ করা হয়।

ব্যয় বিশ্লেষণে প্রতি পাঁচ বছরে একবার ঢাকার বাস সংস্কারে ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। ফলে বার্ষিক খরচ হয় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। দূরপাল্লার বাসের সংস্কার খরচ ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। রাতে বাস রাস্তায় দাঁড় করালেও ঢাকার বাসের গ্যারেজ ফি ৬৫ হাজার টাকা এবং দূরপাল্লার বাসের গ্যারেজ ও টার্মিনাল খরচ ২ লাখ টাকা।

দূরপাল্লার বাসে ৩৩ হাজার টাকা দামের ১৪টি টায়ার-টিউব বাবদ বছরে খরচ হয়েছে ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা।

দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোঃ সাইফুন নেওয়াজ জানান, দুর্ঘটনার তদন্তে দেখা গেছে একই টায়ার বারবার রি-ট্রেড করা হয়েছে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ব্রেক ফেইলিওর। প্রতি তিন মাসে ব্রেক জুতা পরিবর্তন করলে দুর্ঘটনা ঘটবে না। মাসে একবার ইঞ্জিন তেল, মবিল, ফিল্টার এবং এয়ার ক্লিনার পরিবর্তন বা গ্রিজিং করার নজির নেই।

ঢাকার বাসে বছরে একবার পুরো ইঞ্জিন ওভারহল করা এবং মেরামত করতে খরচ ধরা হয়েছে ২৮০.০০০ টাকা। দূরপাল্লার বাসগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ইঞ্জিন ওভারহোলিং বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *