ঋণখেলাপিদের দু:সময়।চট্টগ্রাম

0

চট্টগ্রামের সোপ ও রাসায়নিক শিল্পের মালিক মোহাম্মদ নুরুন্নবী তালুকদার ও তার মেয়ে ব্যবসায়ী আইভি নাসরিন ১৪ বছর ধরে ঋণগ্রস্ত। তাদের অনুসরণ করেও ঋণের টাকা আদায় করতে পারেনি এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা। অর্থ আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও বছরের পর বছর তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। এবারও রক্ষা হলো না। হাজিরা দিতে সরাসরি কারাগারে যেতে হয়েছে ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী নুরুন্নবীকে। একই মামলায় ফেরার জন্য ব্যবসায়ীর মেয়ের বিরুদ্ধে পাঁচ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

শুধু বাবা-মাই ঋণগ্রস্ত নয়; বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীর চারটি ব্যাংক থেকে ১৫৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১২ বছর অধরা ছিলেন। রূপালী ব্যাংকের ৪৫ কোটি ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ টাকা, সিটি ব্যাংকের ৩১ কোটি ৫৭ লাখ ১৩৭২ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের ৫৫ কোটি টাকা ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করলেও তার কাছে কেউ পৌঁছাতে পারেনি! এক যুগ ধরে তার ছায়ার সন্ধানে তাকে হয়রানি করে আসছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা। শেষ পর্যন্ত ঋন খেলাপি হওয়ায় তাকে জেলে যেতে হয়। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে চারটি মামলায় ২০ মাস কারাভোগ নিয়ে তিনি এখন কারাগারের অন্ধকারে জীবন কাটাচ্ছেন।

বছরের পর বছর ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও এবার দুশ্চিন্তায় পড়েছেন খেলাপি ব্যবসায়ীরা। এতদিন ‘রাজা’র হাতে থাকলেও এখন কারাগারে ঢুকেছে খেলাপি, কেউ শাস্তির খবরে পলাতক। কারো নামে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একের পর এক মামলায় সাজা হওয়ায় খেলাপি ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ছাড়া ঋন খেলাপি ব্যবসায়ীদের ‘আশ্রয়’ দেওয়া এক শ্রেণির অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার কাঁপুনিও বেড়েছে। শাস্তি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ব্যাংকের কর্মকর্তারাও। চট্টগ্রামের অর্থ আদালতের বিচারক (যুগ্ম জেলা জজ) মো. মুজাহিদুর রহমানের আদালত গত এক বছরে ঋণ খেলাপির অভিযোগে ২৫ ব্যবসায়ীকে কারাদণ্ড দিয়েছেন। ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. রেজাউল করিম বলেন, “অতীতে খেলাপিদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রেকর্ড ছিল খুবই কম। আদালতের কঠোর অবস্থানের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, যা আগে সম্ভব ছিল না।

প্রাইম ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের প্রধান স্টিল ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিনের বিরুদ্ধে প্রাইম ব্যাংকের একাধিক মামলা রয়েছে। ঋণ খেলাপি কানাডায় পালিয়ে যায়। একটি মামলায় তাকে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা অর্থ সংগ্রহের জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সিটি ব্যাংকের আইনজীবী মো. নাঈম ভূঁইয়া বলেন, আদালত চারটি ব্যাংকের পক্ষে বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীরকে পাঁচ মাস ২০ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। অর্থ আদালত এভাবে চললে খেলাপিরা দ্রুত টাকা ব্যাংকে ফেরত দিতে বাধ্য হবে।

সাজাপ্রাপ্ত ২৫ জন খেলাপি ব্যবসায়ী : খেলাপি মামলায় পাঁচ মাসের কারাদণ্ডের পর পালিয়ে আসা চট্টগ্রামের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা হলেন- ইলিয়াস ব্রাদার্স লিমিটেডের পরিচালক যথাক্রমে বিএনপি নেতা মোঃ শামসুল আলম, পরিচালক মো. নুরুল আবছার, মোঃ নুরুল আলম, কামরুন নাহার বেগম ও তাহমিনা বেগম। আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনির স্বামী পারভেজ আলম ও তার শ্বশুর এম এম আলম, শীর্ষ ব্যবসায়ী মো. জয়নাল আবেদীন, মেসার্স চিটাগাং এগ্রো প্রোডাক্টের মালিক মো. শাহ আলম ও তার স্ত্রী আয়েশা বেগম, জয়নাল আবদীন ও আলাউদ্দিন, জেড অ্যান্ড ডে ইন্টারন্যাশনালের মালিক হারুনুর রশিদ ও তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা বেগম, চিটাগাং স্টিল লিমিটেডের মালিক, মেসার্স সাইব স্টিল রি-রোলিং মিলসের মালিক ইসরাত জাহান মনি, ইসমত জাহান মনি ও মোহাম্মদ সিরাজ, জামিনদার সাবেক চেয়ারম্যান মো. মামুন রশীদ চৌধুরী ও ব্যবসায়ী মো. নুর নবী, ব্যবসায়ী আইভি নাসরিন, মোহাম্মদ নুরুন্নবী তালুকদার, ফেরদৌস খান আলমগীর, মেসার্স ইউসুফ অ্যাপারেলস লিমিটেডের এমডি পারভেজ মোহাম্মদ ইউসুফ, চেয়ারম্যান নিশাত সুলতানা ও মেহেরুন নেশা।

খেলাপিদের মাথায় ১৩৮৩টি ওয়ারেন্ট: চট্টগ্রামে ১,৩৬৩ জন খেলাপির বিরুদ্ধে আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল না হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে থানায় পড়ে আছে। চট্টগ্রাম ফাইন্যান্স ক্রেডিট কোর্ট ১৯ জানুয়ারী, ২০২১ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত এই পরোয়ানা জারি করে। এই ওয়ারেন্টগুলির বিপরীতে, আসামিদের গ্রেপ্তারের হার খুবই কম। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, শীর্ষ খেলাপিদের বিরুদ্ধে আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যথাসময়ে পেশ না হওয়ায় মামলাগুলো যথাসময়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তাই বিভিন্ন থানায় এই আদালতের জারি করা ওয়ারেন্ট তামিল ভাষায় আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেন অর্থ আদালত।

পুলিশের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে ঋণখেলাপিরা : চট্টগ্রামে শীর্ষ খেলাপিদের বিরুদ্ধে একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও তামিলের বদলে থানায় রাখা হচ্ছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি না হওয়ায় পুলিশের দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে বলে রোববার চট্টগ্রামের অর্থ ও ঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান বলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *