চট্টগ্রাম নগরী।পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মধ্যে একটি জলাবদ্ধতার ফাঁক

0

চট্টগ্রাম শুধু দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরই নয়, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরও বটে। ফলে এর অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দুর্ভাগ্যবশত, গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম জলাবদ্ধ শহর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত।

এটি একটি আশার বিষয় ছিল যে সরকার বন্যা ত্রাণের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে এবং ২০১৭ সাল থেকে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ২০২৩ সালেও মানুষ সরাসরি এর সুফল পাচ্ছে না। আজও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম বন্যায় তলিয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, নাগরিক জীবন—সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে।

চট্টগ্রামে বন্যার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। চট্টগ্রাম পৌরসভার ইতিহাস যেমন প্রাচীন তেমনি ভৌগলিকভাবেও স্বতন্ত্র। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একমাত্র শহর যেখানে নদী, পাহাড়, খাল এবং সমুদ্র এক বিন্দুতে মিলিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই শহরের জন্য পরিকল্পনা বা মাস্টার প্ল্যানে সমুদ্র, নদী ও পাহাড়কে বিবেচনায় রাখতে হবে। যতবারই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে ততবারই এই বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, বিশেষ বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়নে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে গত ৫০ বছরে আমরা চট্টগ্রাম শহরের ৭০ শতাংশ জলাধার হারিয়েছি। অধিকাংশ খাল বিলীন হয়ে গেছে, নদীগুলো তাদের নাব্যতা হারিয়েছে, পুকুর-পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। প্রকৃতি এখন মানুষের এই বৈরী আচরণের জবাব দিচ্ছে। জলাধার হারিয়ে বা ধ্বংস করে আমরা জলাশয়ে স্থবির হয়ে পড়ছি।

প্রকৃতপক্ষে, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম শহরের জন্য একটি ‘ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করা হয়েছিল। চারটি নতুন খাল খননের কথা ছিল। এর মধ্যে ২০১৪ সালে একটি খালের কাজ শুরু হলেও আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। আরেকটি বড় কথা, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য যে ড্রেনেজ স্কিম তৈরি করা হয়, সেখানে সাধারণত প্রাথমিক ড্রেন, সেকেন্ডারি ড্রেন এবং টারশিয়ারি ড্রেন থাকে – অর্থাৎ প্রথম স্টেজ, সেকেন্ড স্টেজ এবং তৃতীয় স্টেজ ড্রেন। কিন্তু সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলোতে বড় বড় ড্রেন মেরামতের কাজ চলছে কিন্তু মৌলিক সংযোগগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে পানি প্রবাহ সীমাবদ্ধ থাকে; বড় খাল বা ড্রেনে পৌঁছাচ্ছে না। এটি প্রকল্প পরিকল্পনার একটি বড় দুর্বলতা।

আরেকটি বিষয় হলো, চট্টগ্রাম নগরীর ২২টি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ফলে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল- এক ছাতার নিচে নগর শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে; এটা সম্ভব ছিল না। আজও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রশাসনিক দূরত্ব রয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও কোনো ফল না হলে একটি প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের দিকে আঙুল তোলে।

শুধু চট্টগ্রাম শহর নয়; জাতীয় পর্যায়েও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০ সালে দেশে জলাধার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোর শিথিলতা স্পষ্ট। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নে আগ্রহ; অবকাঠামো তৈরির পর তা রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিচালনায় শিথিলতা রয়েছে। ড্রেন তৈরি করাই শেষ নয়। ড্রেনটি সবসময় রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগ না দিলে এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে।

চট্টগ্রামের ড্রেনেজ ব্যবস্থায় টপোগ্রাফি মাথায় রাখতে হবে। শহরটিতে অনেক পাহাড় রয়েছে এবং জমিনে বালুকাময়। যার কারণে প্রতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে প্রচুর পরিমাণে বালু ভেসে যায়। এই বালি ড্রেনে যাওয়ার আগে ‘সিল্টট্রাপ’ তৈরি করে অপসারণ করার কথা ছিল। কারণ আমরা এই ধরনের সিলট্র্যাপ তৈরি করতে পারি না, বালি সরাসরি ড্রেনে গিয়ে তার নাভিকে নামিয়ে দেয়। আর সেখানে ক্যাচমেন্ট এলাকার পানি উপচে পড়ছে।

আমাদের শহরাঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাশয় রক্ষার জন্য জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সহ সরকারি দপ্তরের শিথিল মনোভাব এবং পানি সংরক্ষণ আইন, ২০০০-এর কঠোর প্রয়োগ বা মনিটরিং অবশ্যই কাটিয়ে উঠতে হবে। আইন প্রয়োগের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং জলাধারগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে।

আমরা জানি চট্টগ্রাম শহরের আয়তন ১৫৫ বর্গকিলোমিটার। ৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এখানে বাস করে। সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন আবর্জনা তৈরি হয়। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন সর্বোচ্চ দুই হাজার টন গৃহস্থালির বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারবে। বাকি ১ হাজার টন আবর্জনা যায় কোথায়? এই বর্জ্যের বেশির ভাগই যায় ড্রেন ও খালে। ফলে যত নতুন ও পুরাতন খাল সংস্কার করা হয়; একটি ড্রেন করা; প্রতিনিয়ত ড্রেনে ফেলা আবর্জনা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *