ঝুট ব্যবসায়ী থেকে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম

0

তরুণ মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান ছিল বেশ নাটকীয়। কৃষকের ঘরে জন্ম নিলেও অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন বিপুল সম্পদের মালিক। এ কারণে বিপুল রাজনৈতিক শক্তিও আসে, যার চূড়ান্ত রূপ ছিল মেয়র পদে বিজয়। তবে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেন। নিজের বাহিনী গড়ে তুলেছেন, কোনো টেন্ডার ছাড়াই মহানগরে শত শত কিলোমিটার নতুন রাস্তা তৈরি করেছেন, যাতে অনেকেই দুর্নীতির গন্ধ পান। উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয়দের হাজার হাজার বিঘা জমি হারিয়ে গেলেও যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেননি তিনি। অনেকের অভিযোগ, তিনি গাজীপুর সিটির ‘নিরঙ্কুশ শাসক’ হতে মরিয়া হলেও রক্ষা পাননি।

২০১৮ সালে, জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ কর্তৃক ৩৮বছর বয়সে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করেন। সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ থেকে জাহাঙ্গীর স্বেচ্ছাচারী হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিজের ক্ষমতা ও সম্পদের কারণে কাউকে তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছে মতো নগর ভবন ও দল চালাচ্ছেন।

জাহাঙ্গীর ১৯৭৯ সালে গাজীপুর মহানগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইয়া গ্রামে কৃষক মিজানুর রহমানের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলজীবনেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গাজীপুরের চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন জেলার ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা

বিভিন্ন ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সময় তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন। পরে তিনি এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহসভাপতি হন।

ছাত্র রাজনীতির পর ২০০৯ সালে গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মূলত তার উত্থানের শুরু। শিল্পনগরী গাজীপুরের বিভিন্ন কল-কারখানায় বেনামে জাল ব্যবসা শুরু করে সে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য তিনি নিজস্ব বাহিনী তৈরি করেন। অল্প সময়ের মধ্যে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন জাহাঙ্গীর। চড়া দামে বিঘা জমি কিনেছেন। জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, তার টাকার পরিমাণও তিনি জানেন না। অনেক আগেই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

তবে তিনি এলাকায় পরোপকারী হিসেবে পরিচিত। কেউ তার কাছে সাহায্যের জন্য গেলে ফিরে আসে না। করোনা মহামারীর শুরুতে চীন থেকে এক লাখ কিট এনেছিলেন তিনি। তখনও সরকার কিট আনতে পারেনি। রাষ্ট্র যেখানে ব্যর্থ সেখানে জাহাঙ্গীর আলম সফল।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও দলের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জাহাঙ্গীর জাতীয় শোক দিবসে মহানগরীর ৫৬টি ওয়ার্ডে একটি করে গরু দিয়ে ভোজের আয়োজন করতেন। এটাকে তার কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন নেতাকর্মীরা। তিনি দ্রুত জেলার সকল সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের পেছনে ফেলে সামনের কাতারে চলে যান। তবে অল্প সময়ে তার উত্থান ও দলের সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন মেনে নেননি দলের নেতাকর্মীরা। ফলে এখানে রাজনীতি বিভক্ত।

বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের লোকজন নিয়ে দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন’ গঠন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সবকিছু করলেও সেখানে দলের সব নেতাকর্মীরা অবহেলিত। ওই সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। মহানগরীর ৫৬টি ওয়ার্ডে সংগঠনটির কমিটি রয়েছে।

তার সমর্থকরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীর’ স্লোগান দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করা হয়নি। অনেকেই বলছেন, এই ফাউন্ডেশনের পেছনে জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছেন। দলকে সংগঠিত না করে নিজের সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন।

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের ইচ্ছে মতো সিটি করপোরেশন পরিচালনা করতে থাকেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বৈঠকে প্যানেল মেয়র নির্বাচনের নিয়ম ভঙ্গ করে যাত্রা শুরু করেন জাহাঙ্গীর। তার মেয়াদের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও প্যানেল এখনো মেয়র নির্বাচন করতে পারেনি। কয়েকজন কাউন্সিলর অভিযোগ করেন যে জাহাঙ্গীর চেয়েছিলেন যে সবাই তার আদেশের দাস হোক।

মেয়র হওয়ার পর নিজ উদ্যোগে মহানগরীতে তিনশ জনকে ট্রাফিক সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। এভাবে তিনি নগরীর যানজট নিরসনের দায়িত্ব তথাকথিত ট্রাফিক সহকারীদের হাতে তুলে দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের পেশাগত কর্তৃত্ব খর্ব করেছেন। এভাবে তিনি শহরের সড়ক-মহাসড়কের প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেন। এরপর যানজট নিরসনের নামে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য শহরজুড়ে সার্কুলার বাস সার্ভিস ‘তাকওয়া পরিবহন’ চালু করেন। প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশের পরিবর্তে, তার ট্রাফিক সহকারীরা মহানগর জুড়ে রাস্তা শৃঙ্খলার বারো রাউন্ড বাজান। কোনো নগরবাসী এমআইয়ের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে সাহস পায়নি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *