পর্যটন স্পটগুলোতে নিরাপত্তা নেই, পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

0

এক নববধূ তার স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে একদল দুর্বৃত্ত তার স্বামীকে বেঁধে রেখে তাঁকে ধর্ষণ করে। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার টিক্কা হাওয়ারে এ ঘটনা ঘটে। একই বছরের ৩১ মার্চ বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি ইকোপার্কে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন তরুণী। সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল ঢাকার রায়েরবাজারে স্নানভূমি স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনে গিয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হন দুই জাপানি নাগরিক। পর্যটন স্পট বা বিনোদন কেন্দ্রে যাওয়ার সময় ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ছিনতাই, হয়রানি বা শ্লীলতাহানির ঘটনা সাধারণ।

ভুক্তভোগীদের মতে, যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এছাড়াও, নিরাপত্তা সতর্কতার অভাবে পর্যটকরা পানিতে ডুবে বা দুর্ঘটনার কারণে মারা যাচ্ছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১,৬৭৫টি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি জেলার ১০৪টি স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছেন। অন্য কথায়, বাকি ১,৫৭১স্পটে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই। বিশেষ দিবসে কিছু স্পটে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করলেও অন্য সময়ে স্পটগুলো অরক্ষিত থাকে। ফলে যাতায়াতের সময় অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। এ কারণে মানুষ পর্যটন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

পর্যটন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে প্রায় ৪০০টি স্পটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে বিদেশী এবং বিভিন্ন জেলার লোকজন ভ্রমণ করেন, সব স্পটে না হলেও।

ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে আকর্ষণীয় পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে। ছয় ঋতুর পরিবর্তনে আমাদের বন, পাহাড়, নদী, সাগর-নদী জেগে ওঠে নতুন রূপে। পর্যটন উন্নয়নে নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নিরাপদ পর্যটন করতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে পর্যটন পুলিশ। পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কারণে সব স্পট এখনো ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবায় আনা হয়নি।

ট্যুরিস্ট পুলিশের মঞ্জুরিকৃত জনবল ১ হাজার ৩৯৪ হলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ১ হাজার ১৯১ জন। ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট ছাড়া বেশিরভাগ স্পট নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে। এমনকি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত, চন্দ্রনাথ পাহাড়, মিরসরাইয়ের খৈয়াচড়া ঝর্ণা, বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি খাল (মূলত একটি উপনদী) এর মতো জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলো কার্যত অরক্ষিত। পর্যটকরা এসব স্পটে গিয়ে নানা সমস্যা ও দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন।

গত বছরের ১৯ জুন মিরসরাইয়ের নাপিত্তাছড়া জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে তিন যুবক নিখোঁজ হয়। পরে ঝরনার নিচ থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন- ইশতিয়াকুর রহমান মার্গ, মাসুদ আহমেদ তানভীর ও তার ছোট ভাই তৌফিক আহমেদ তারেক। এর আগে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল খৈয়াছড়া জলপ্রপাত থেকে পা পিছলে আশরাফ হোসেন নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। একই বছরের ২৮ জুন জলপ্রপাত থেকে পড়ে আনোয়ার হোসেন মারা যান। এ ছাড়া পর্যটকদের টাকা, ফোন বা ক্যামেরা ছিনতাই, নারীদের শ্লীলতাহানি এবং স্থানীয় ফটোগ্রাফাররা হয়রানির শিকার হয়।

২০২২ সালে ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি গবেষণা প্রতিবেদন পরিষেবার মান এবং পরিধি বাড়ানোর জন্য তিন মেয়াদে ২০টি সুপারিশ করেছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় (২০২৫ সালের মধ্যে) নারী সদস্যসহ ট্যুরিস্ট পুলিশের জনবল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পর্যটন সংক্রান্ত সকল সেবায় ট্যুরিস্ট পুলিশের আরও সম্পৃক্ততা, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, পুলিশ সদস্যদের (বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে) উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধকরণ, নিরাপত্তায় নিয়োজিত অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এবং পর্যটক এবং পর্যটন। ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

অধ্যয়নের মধ্য-মেয়াদী (২০২৫-২০৩৫) সুপারিশগুলি শুরু থেকেই ট্যুরিস্ট পুলিশদের আলাদা নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের আহ্বান জানিয়েছে৷ এ জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে। এতে পর্যটন স্পটে নিরাপত্তা টহলের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুবিধার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়।

এর মধ্যে রয়েছে- হেলিকপ্টার রেসকিউ টিম, ডাইভিং টিম, সাইকেল, মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান, স্পিডবোট, মোটর চালিত নৌকা, ড্রোন নজরদারি, হ্যান্ড মাইক, স্মার্টফোন, প্রতিটি স্পটের জন্য বিশেষ উদ্ধারকারী দল, নিজস্ব মেডিকেল টিম এবং উপযুক্ত গোয়েন্দা নজরদারি সরঞ্জাম। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্র বাড়ানো এবং দেশের সব পর্যটন স্পটকে ট্যুরিস্ট পুলিশের আওতায় আনা এবং পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশগুলি ট্যুরিস্ট পুলিশের দক্ষতা, সক্ষমতা, ব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয় উন্নত করার জন্য আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *