মজুতদাররাই পেঁয়াজের কারসাজির হোতা

0

এবারও পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। কয়েক লাখ টন আমদানি হয়েছে। স্টক যথেষ্ট। তবে মসলাযুক্ত পণ্যের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। মাত্র এক মাসে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ পেঁয়াজ কৃষকের কাছ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে গেছে। ভারত থেকে আমদানি বন্ধের অজুহাতে তারা মূলত বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারা উল্লেখযোগ্য সরকারি তদারকির অভাবের সুযোগও নিয়েছে। এ কারণে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ফলে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর কারসাজির মূল নায়ক মজুতদার বা মজুতদাররা। তবে সরকার বলছে, আমদানির বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। সে বছর দাম বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি কেজি ৩০০ টাকার কাছাকাছি। পরের বছরও রিলিজ করে ২০০ টাকা। এভাবে গত তিন বছর ধরে পেঁয়াজের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল। তবে সরকার উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিলে তাও লাভজনক হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ১৭ লাখ ১ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টনে। সে অনুযায়ী গত ১০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। একইভাবে আবাদি জমির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আবাদি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। একইভাবে পেঁয়াজের ফলনও বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে হেক্টরপ্রতি ৯ লাখ ১০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল, সেখানে চলতি অর্থবছরে তা হয়েছে হেক্টরপ্রতি ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। তবে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ পচে যায়। এমনকি গড়ে ৩০ শতাংশ পচে গেলেও মোট উৎপাদন হয় প্রায় ২৪ লাখ টন। অন্যদিকে দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। সে অনুযায়ী দুই থেকে চার লাখ টন ঘাটতি রয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৮ লাখ ৩১ হাজার ১৭০ টন পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে।

তবে চলতি অর্থবছরে মৌসুম শুরুর আগেই পেঁয়াজ আমদানি খোলা ছিল। তখন কয়েক লাখ টন পেঁয়াজ এসেছে। ফলে তেমন সংকট হওয়ার কথা নয়। এবং এমনকি যদি একটি সংকট থাকে, এটি মৌসুম শুরুর আগে হওয়া উচিত। কিন্তু এখন পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮০ টাকা এবং আশপাশে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অর্থাৎ এক মাসে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের দাম। আগের কিছু আমদানি করা পেঁয়াজ এখনো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। বড় আকারের এসব পেঁয়াজও বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। এক মাস আগেও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা থেকে ৪২ টাকা। এ ধরনের পেঁয়াজের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

ভারত ও মিয়ানমার থেকে সারা বছরই কমবেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়। তবে উৎপাদন মৌসুমে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় আমদানির মেয়াদ বাড়ায়নি কৃষি মন্ত্রণালয়। ১৬ মার্চ থেকে আমদানি বন্ধ রয়েছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে ঈদের পর থেকেই দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান জানান, দুই মাস ধরে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে না। এ কারণে দাম বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত বছর এ সময়ে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে পণ্যটির দাম গড়ে ৮৭ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের ১০টি জেলায় সাধারণত পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে বেশি পাবনা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ীতে। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্র জানায়, দেশের মোট চাহিদার এক চতুর্থাংশ পাবনায় উৎপাদিত হয়। এ বছর পাবনার ৯টি উপজেলায় প্রায় আট লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬২ হাজার ৩৩৬ টন বেশি।

পাবনার সুজানগরের বাগাজানী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি হাবিবুর রহমান জানান, এবার পেঁয়াজ আবাদের সময় অতিবৃষ্টির কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার পেঁয়াজ লাগাতে হয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজ উঠার পরই তারা ২০ টাকা থেকে ২২ টাকা দরে বিক্রি করে। পেঁয়াজ পাইকাররা কিনে মজুত করে। কিন্তু এখন পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে কৃষকের কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ, এখন কৃষকের কাছে যে পেঁয়াজ আছে, তা খুবই কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *