তিন সীমান্তে বিপাকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা

0

৪৫ বছর বয়সী প্রণব সরকার। আড়াই বছর আগে ফুলবাড়ী ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার নিজের পরিবার ছাড়াও বেশ কয়েকজন কর্মচারীর পরিবারও তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। শুধু প্রণব নয়, পশ্চিমবঙ্গের ফুলবাড়ি সীমান্তে ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১৭০০ বাসিন্দার এই অবস্থা।

২০২০ সালের মার্চের শেষের দিকে, করোনার সময় এই সীমান্ত দিয়ে ভারতে বাংলাদেশিদের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এই সীমান্তের বাংলাদেশের পাশে। করোনা শুরুর আগে অনেক বাংলাদেশি বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি রুটে ভারতের শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, সিকিম যেতেন। এতে তাদের খরচ ও সময় বাঁচবে; একইভাবে ফুলবাড়ীর ব্যবসায়ীরাও পর্যটকদের কাছ থেকে লাভবান হবেন। মানি এক্সচেঞ্জার, হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ ও পরিবহন ব্যবসায়ীরা এসব পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এই রুট দিয়ে বাংলাদেশিদের ভারতে ভ্রমণ ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও চলতি বছরের এপ্রিলে দুই দেশের সরকার তা তুলে নেয়। তবে ট্রাভেল ভিসায় বাংলাদেশিদের এই সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক নয়। এর প্রভাব পড়েছে সীমান্ত এলাকায় ভারতীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যে। অনেক শ্রমিক, কর্মচারী ও ব্যবসায়ী আক্ষরিক অর্থে অমানবিক জীবনযাপন করছেন।

পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গেদে এবং মালদহ জেলার মাহাদিপুর সীমান্তবর্তী এলাকার ব্যবসায়ীদের অবস্থাও একই রকম। বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে গেদে চেকপোস্ট দিয়ে সড়ক পথে বাংলাদেশীরা সহজেই কলকাতায় আসতে পারত। গেদে সীমান্ত দিয়ে সড়কপথে এখনও ভারতীয় ভিসা পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গেদে সীমান্তের ব্যবসায়ীরা। এ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের সব ধরনের ভিসা দেওয়ার দাবিতে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। মাহাদীপুর সীমান্তের বাংলাদেশ পাশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনামসজিদ স্থলবন্দর। মাহাদীপুর চেকপোস্ট দিয়েও ভারতে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা। এতে বিপাকে পড়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরাও।

মহামারীর পর যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বাংলাদেশীদের ভারতে প্রবেশের জন্য ভিসা দেওয়া হয়, তখন ফুলবাড়ী, গেদে ও মাহাদীপুর সীমান্তের ব্যবসায়ীরাও আশার বুক বেঁধেছিলেন। তাদের প্রত্যাশা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হবে, আয়-রোজগার গতি ফিরে আসবে। কিন্তু এসব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের ভারতে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় এলাকার অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আক্রান্ত বাংলাদেশীরাও। তারা কাঙ্ক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভিসা দেওয়ার জন্য ভারতীয় হাইকমিশনকে অনুরোধ করেছে।

ফুলবাড়ী ছাড়াও মাহাদীপুর ও গেদে সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৪৫০০ মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাত্রী সেবা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের অনেকেই করোনা ভাইরাসে জীবিকা হারিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। অনেকেই অপেক্ষায় আছেন, কবে সীমান্ত স্বাভাবিক হবে। আড়াই বছর আগে ফুলবাড়ী সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত ২৫ থেকে ৩০টি মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার খোলা হয়। বর্তমানে মাত্র পাঁচ-ছয়টি কাউন্টার খোলা, বাকিগুলো বন্ধ। তিন সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৭০ শতাংশ হোটেল ও ৮০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন ব্যবসা বন্ধ রয়েছে।

মানি এক্সচেঞ্জার হরিপদ সাহা বলেন, ফুলবাড়ি সীমান্ত থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দর মাত্র ১১ কিলোমিটার। আর যেহেতু নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে, তাই বাংলাদেশিরা উত্তরবঙ্গ হয়ে এই সীমান্ত ব্যবহার করতেন। এই সীমান্তে যাতায়াত বাড়লে ব্যবসাও বাড়তে থাকে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই করোনা মহামারির কারণে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাতায়াত বন্ধ থাকায় বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের বাংলাদেশিদের। ফলে পাসপোর্ট যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে, বেড়েছে ভোগান্তি। যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ সময় লাগছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ডিসেম্বরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, গত ৭ এপ্রিল বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী স্থলবন্দর খুলে দেওয়া হলেও ভিসা আবেদনে ফুলবাড়ী চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা। পঞ্চগড়সহ এ অঞ্চলের বাংলাদেশিদের লালমনিরহাটের বুড়িমারী বা যশোরের বেনাপোল হয়ে ভারতে যেতে হয়। এ নিয়ে স্থানীয় আমদানি-রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ী, রোগী ও যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। পুরান পঞ্চগড় এলাকার কামরুজ্জামান কামু জানান, করোনার আগে তিনি তার বাবা-মাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যান। সেখান থেকে দেওয়া অর্ডারে ওষুধও দেওয়া হয়। কিন্তু পরে তাকে ফুলবাড়ী দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না জেনেও তিনি ভিসার জন্য আবেদন করেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *