বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ে ধ্বংসের ক্ষত

0

বান্দরবান একটি পর্যটন শহর। পাহাড়ে ঘেরা। আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা আর সবুজাভ দৃষ্টিনন্দন। সাম্প্রতিক আকস্মিক বন্যায় সেই সৌন্দর্যের শহর অচেনা হয়ে উঠেছে। এক সপ্তাহের টানা ভারী বর্ষণ ও ভূমিধস শহরকে গ্রাস করেছে। বন্যার পানি কমলে বান্দরবান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

গত ৬ আগস্ট রাতে বান্দরবানে বিদ্যুৎ চলে যায়। সেই সঙ্গে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পরিষেবা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পর্যটন শহরটি রাস্তার নিচের কারণে কার্যত দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। ছবির মতো ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয় শহরে। বিদ্যুৎ নেই, খাবার পানির সংকট, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চেনা শহর অচেনা। যেন বান্দরবান বিধ্বস্ত শহরে পরিণত হয়েছে।

৯ আগস্ট দুপুরের দিকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। পানি কমতে থাকায় সৌন্দর্য্য পর্যটন শহরের ধ্বংসের চিত্র উঠে আসে। রাস্তাঘাট কাদায় ভরা, যত্রতত্র আবর্জনা ছড়িয়ে আছে। রাস্তার পাশে কোথাও মাটির ঘর ধসে পড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় এবং টিউবওয়েল ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় দোকানগুলোতেও বোতলজাত পানি ফুরিয়ে গেছে। ৫ টাকার মোমবাতি ২০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছিল না। বন্যার পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় বাজারে ভোজ্য সবজি নেই। বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর পর্যটন শহরটি বিধ্বস্ত হয়েছে।

৭ ও ৮ আগস্টের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ৫৫ বছর বয়সী দুল্লবী তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বলেন, ‘সেদিন ছিল সোমবার রাত। খুব বৃষ্টি হচ্ছে. বাড়ি ছাড়ার সুযোগ নেই। পরের দিন মঙ্গলবার ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির সামনে পানি। আমি তড়িঘড়ি করে আমার মেয়ে এবং আমার এক বোনের মেয়েকে জাগিয়ে দিলাম। বৃষ্টিতে ভিজে কিছু জিনিস পাহাড়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখেছিলাম। তাড়াহুড়ো করে বস্তায় কয়েক কেজি চাল আনতে ভুলে গেছি। আনার কথা মনে পরে দেখলাম চালের বস্তা পানিতে ডুবে গেছে। চারিদিকে পানি আর পানি। পুরো এলাকাটাই যেন সাগরে ভাসছে। আমি দুই দিন (বুধবার পর্যন্ত) বৃষ্টির পানি পান করেছি। আত্মীয়ের বাড়ির চাল ফুরিয়ে গেছে। বাঁশের কুরুল (বাঁশের বাঁশ), কিছু আলু খেয়ে দুই রাত কাটালাম।’

শুধু দল্লবী তঞ্চঙ্গ্যা নয়; বন্যার কবলে পড়ে তার মতো নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ। যেখানে পানি ওঠার কথা নয়, সেখানেও বন্যার পানিতে ডুবে যায়। ৭ আগস্ট সকাল থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। পরের দিন সকালে নিম্নচাপ কমতে শুরু করে। লামা, থানচি, রুমা, রাওয়াংছড়ি উপজেলার বাজার, অফিস, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফায়ার সার্ভিসসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ডিসি বাংলো, এসপি বাংলো, জজকোর্ট, চিফ জুডিশিয়াল কোর্ট, ফায়ার সার্ভিস, পাবলিক লাইব্রেরি, সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সদর উপজেলা কার্যালয়, নির্বাচন অফিস, পুলিশ লাইন, রেডিও সেন্টার, সেনা ব্রিগেড এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন। সবুজ আর বন্যার পানিতে প্লাবিত হতে থাকে এলাকা। মঙ্গলবার বিকেল নাগাদ বন্যার পানি ভবনের নিচতলায় প্রবেশ করে। নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের কিছু অংশে পানি উঠে যায় পানির স্তর। যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। সেই নৌকারও সংকট ছিল। অল্প কিছু নৌকাই ছিল পারাপারের মাধ্যম।

যেসব পর্যটক বান্দরবান শহরকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখেছেন, তারা এখন শহরটি দেখলে অবাক হবেন। বিধ্বস্ত শহরকে চিনে! বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন যাতায়াত শুরু করলে থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি সড়কে ভূমিধসের ধ্বংসাবশেষ দেখা দেয়। আঁকাবাঁকা সর্পিল পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে চাঁদের গাড়িতে চড়ে চিম্বুক, নীলগিরি, বগালেক, কেওক্রাডং, থানচি সহ নজরকাড়া স্পটগুলোতে গান গেয়ে যাওয়া যায়; সেই সৌন্দর্য এখন কলঙ্কিত। থানচি যাওয়ার পথে ভূমিধসের দাগ দেখতে পাবেন। এমনকি থানচি যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটিও আজ চেনার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ৩০ কিলোমিটার এলাকায় পুরবাংলা নামক স্থানে ভূমিধসে সড়কের একটি বড় অংশ বিধ্বস্ত হয়েছে। কবে নাগাদ এ সড়ক স্বাভাবিক হবে তা বলতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

রুমা উপজেলা সদরে যাওয়ার রাস্তারও বেহাল দশা। সড়কটি অন্তত ৩২টি স্থানে ভেঙে পড়েছে। রুমাকে পাওয়ার একমাত্র ভরসা এখন নদী। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের মাধ্যমে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে- সাত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা ভেঙে গেছে। থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি সড়কেও ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ‘বান্দরবানে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বলা যায় পুরো জেলা শহর প্লাবিত হয়েছে। ১১ আগস্ট বিকেলে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, বন্যার পানি ও ভূমিধসে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে ৮ হাজার ২৫৩ হেক্টর ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫ হাজার ৮০০ পরিবারের ৬০ হাজার মানুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *